ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জন্য এটি ছিল এক বিশাল ধাক্কা। সেখান থেকে আর ফেরার কোনো উপায় নেই। এখন ইউক্রেনের একমাত্র ভরসা ইউরোপ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যে যা-ই ভাবুক, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে হওয়া হোয়াইট হাউসের বৈঠকের টেলিভিশন সম্প্রচার দেখে সবাই হতবাক হয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে আরেকটু হলেই এই আলাপ পুরোপুরি চিৎকার-চেঁচামেচির পর্যায়ে চলে যেত।
এই বৈঠক উত্তপ্ত হতেই পারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের উপস্থিতি একে দ্রুত বিশ্রী রূপে নিয়ে গেল। জেলেনস্কির কথা বারবার থামিয়ে দিয়ে ভ্যান্স বললেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার জন্য যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেননি—‘আপনি কি কখনো ধন্যবাদ দিয়েছেন?’।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, জেলেনস্কি ট্রাম্পকে যথাযথ সম্মান দেখাচ্ছেন না। এর চেয়ে বড় কথা, খোলাখুলি নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করায় তাঁকে ভর্ৎসনা করলেন। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
ন্যায্যভাবে বললে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সের পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছেন। সেটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ হয়নি। জেলেনস্কি বলতেই পারতেন, তিনি অতীতেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, আবারও তা করতে চান এবং যুক্তরাষ্ট্রে এসে ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে পেরে আনন্দিত, এমন সব কথা।
আপনার কাছে এমন সব কথা আপত্তিকর এমনকি অসম্মানজনকও মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন, ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করলে দুটি নিয়ম মেনে চলতে হয়—ট্রাম্পকে প্রশংসায় ভাসাতে হবে এবং তর্কে জড়ানো যাবে না। এই কৌশল কাজ করে।
কয়েক দিন আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বৃহস্পতিবার ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করলেন। সেই বৈঠকও প্রকাশ্যে হয়েছিল। সেখানে কিন্তু অবস্থা ছিল একেবারে ভিন্ন। স্টারমার যেন একদম সুরে বাঁধা বেহালার মতো বাজালেন ট্রাম্পকে।
দেখা গেল, স্টারমার আন্তরিকভাবে মাথা নাড়লেন, হাসলেন, আর শেষ মুহূর্তে পকেট থেকে বের করলেন ব্রিটেনের রাজা চার্লসের আমন্ত্রণপত্র। ট্রাম্পকে যুক্তরাজ্যে আসার জন্য দাওয়াত জানিয়েছেন রাজা চার্লস। এই আমন্ত্রণ কত গুরুত্বপূর্ণ, তা–ও স্টারমার জোর দিয়ে বললেন। ট্রাম্প এক মুহূর্তের জন্য চমকে গেলেন। তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে হাসলেন এবং যুক্তরাজ্য ও রাজপরিবারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন।
ট্রাম্প হয়তো ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করতে পারেন। এতে আমেরিকার নিরাপত্তার তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। কিন্তু ইউরোপের পক্ষে তা করার কোনো উপায় নেই। ইউক্রেনের নিরাপত্তা সরাসরি ইউরোপের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। তাই ইউক্রেন ও ইউরোপ—উভয়েরই এখন একটি ‘ট্রাম্প সমস্যা’ মোকাবিলা করতে হবে।
স্টারমার কি খুব বেশি মাথা নুইয়েছিলেন? হ্যাঁ। দেখতে কিছুটা অস্বস্তিকর লাগছিল? অবশ্যই। কিন্তু তার কৌশল কি কাজ করেছিল? একদম। ট্রাম্পকে সামলানোর এ ছিল এক দুর্দান্ত পাঠ।
কিন্তু জেলেনস্কির এখন আর এই কৌশল প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে কোনো যৌথ সংবাদ সম্মেলন হয়নি। হোয়াইট হাউসের উত্তপ্ত বৈঠকের পর কোনো রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের সম্ভাবনাও ছিল না। যে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল, সেটিও এখন প্রায় বাতিল হয়ে গেছে। শেষমেশ, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেছেন।
এখন ইউক্রেন কী করবে? ট্রাম্প-জেলেনস্কির ঝগড়ার ভিডিও কিছুদিন খবরের শিরোনাম থাকবে। ডিনার টেবিলে আলোচনা হবে, কিছু জায়গায় হয়তো তর্কবিতর্কও হবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটি খুব একটা গুরুত্ব পাবে না।
তবে জেলেনস্কির আর ফেরার কোনো পথ নেই। ট্রাম্প অপমান ভুলতে পারেন না, শত্রুতা মনে রাখেন এবং কাউকে ক্ষমা করেন না। খনিজ চুক্তির বিষয়টি বাদ দিলেও সবচেয়ে বড় ধাক্কা হলো, ট্রাম্প কার্যত ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। যুদ্ধের পর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইউক্রেন যে আশা করেছিল ন্যাটোর সদস্যপদ পাবে, সেটি এখন একপ্রকার অসম্ভব হয়ে গেছে। বিশেষ করে হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার মতো ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনকে ঠেকিয়ে রাখার পক্ষে।